ভূমিকা
বাবা---
একটা ছোট শব্দ, অথচ জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।
আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি ভুলে, প্রতিটি শিক্ষায়
বাবার উপস্থিতি থেকে যায় কখনো শাসনে, কখনো ভালোবাসায়,
আবার কখনো চোখের কান্নায়।
আজ আমি বাবাকে বলতে চাই,
যা কখনো তাঁর সামনে উচ্চারণ করতে পারিনি-
“বাবা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
আমার বাবা
বাবা,
তুমি হয়তো ভাবতে
আমি শুধু মাকেই বেশি ভালোবাসি।
কিন্তু আজ সত্যিটা বলি-
আমি তোমাকে সমান ভালোবাসি,
এক বিন্দুও কম নয়।
যখন মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো,
আমি ছিলাম বিদেশের মাটিতে।
রাতের পর রাত মসজিদের কোণে কাটিয়েছি,
তাহাজ্জুদ পড়ে, চোখ ভিজিয়ে
আল্লাহর কাছে কেঁদেছি-
“আমার মাকে সুস্থ করুন।”
অবশেষে আর পারিনি-
সব ছেড়ে দেশে ফিরে এলাম।
মাকে নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ার টাটা হাসপাতালে,
ফিরে এলে শুনলাম তোমার কণ্ঠে অভিমান-
“তোমার ছেলে তোমাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে,
তোমার জন্যই বিদেশ থেকে ছুটে এসেছে।”
তখন উত্তর দিতে পারিনি,
কিন্তু হৃদয়ের গভীর থেকে চেয়েছি বলতে-
না বাবা,
তোমাকেও আমি সমান ভালোবাসি,
তোমরা দুজনেই আমার জীবনের দুই ডানা।
শৈশবের কথা মনে পড়ে-
বন্যার দিনে জেদ করে পানিতে নামতে চাইলাম,
তুমি রাজি হলে, পা কেটে গেলো।
তোমার আতঙ্কিত চোখ,
তোমার বুকের কোলে আমার নিরাপত্তা-
আজও সেই দৃশ্য চোখে ভাসে।
মনে পড়ে ধানক্ষেতের দিন-
আমি ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র,
কয়েকটা ধান কাটতেই সাপ কামড়ালো।
তুমি জামা ছিঁড়ে আমার পা বেঁধে দিলে,
কোলে তুলে উঠোনে দৌড়ালে।
সেদিন বুঝলাম,
তোমার ভালোবাসা শুধু কোমল নয়,
ঢালের মতো শক্তও।
তোমার শাসনের কথাও মনে পড়ে-
ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন,
ফুফুরা এসেছিলো,
আমি স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলাম।
তুমি এসে বললে মাকে,
“মামুন কোথায়?”
মা বললেন-মাঠে খেলছে।
তুমি রাগে দাঁত ভেঙে দিলে।
তখন কষ্ট পেয়েছিলাম,
আজ বুঝি- সেই শাসনেই ছিলো আমার জন্য শিক্ষা।
মনে আছে বাবা,
প্রথম চা খাওয়ার দিন,
আমি শব্দ করে খেয়ে ফেলেছিলাম।
তুমি থাপ্পড় মেরেছিলে-
“এভাবে শব্দ করে খেতে নেই।”
আজ অবধি সেই অভ্যাস আর হয়নি।
তোমার শাসনই শিখিয়েছে
ভদ্রতা, শৃঙ্খলা, মানে চলা।
তুমি আমাকে বাড়ির বাইরে যেতে দিতে না,
বলতে-“বাউন্ডারির বাইরে নয়।”
সেই বড় উঠোনেই সাইকেল চালানো শিখিয়েছিলে।
তোমার কথার প্রতি শ্রদ্ধা ছিল এতটাই,
এসএসসি পাশ করার পরও
আসরের আযান হলেই ঘরে ফিরে আসতাম।
আজ বুঝি,
তোমার সেই নিয়মই আমার জীবনের নিয়মানুবর্তিতা।
আমাদের গরুর কথা মনে আছে বাবা-
যেটা থেকে আমরা দুধ খেতাম।
একদিন তুমি বাসায় ছিলে না,
দাদী বললেন-“ খড় কেটে দিতে,
বাবার কষ্ট কমতো।”
আমি চেষ্টা করলাম,
কিন্তু খড়ের গন্ধে বমি হয়ে গেলো।
তুমি ফিরে এসে আমাকে দেখে কেঁদে ফেললে।
দাদীকে বললে-
“মামুনকে দিয়ে এসব কাজ কেন করালে?”
তখন বুঝিনি, আজ বুঝি-
তুমি আমাকে কষ্ট থেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলে।
আরো মনে পড়ে-
রাস্তা দিয়ে হাঁটলে বলতে-
“সাইনবোর্ডটা পড়ো।”
বাজার থেকে এলে বসিয়ে হিসাব শেখাতে।
আমাদের দোকানের পিছনে ব্ল্যাকবোর্ড বসিয়ে দিলে,
যেন আমি পড়াশোনা করি।
প্রতিটি অক্ষরে ছিলো তোমার স্বপ্নের ছাপ।
বাবা,
তোমার ভালোবাসা ছিলো
কখনো কোমল, কখনো কঠোর,
কখনো শাসন, কখনো কান্না।
তুমি আমাকে শিখিয়েছো-
কীভাবে চলতে হয়, কীভাবে মানুষ হতে হয়।
আজ আমার দুঃখ একটাই-
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে
কখনো বলতে পারিনি,
“বাবা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।”
উপসংহার
বাবা,
তুমি ছিলে আমার শাসন,
তুমি ছিলে আমার দিকনির্দেশনা,
তুমি ছিলে আমার নিরাপদ আশ্রয়।
আজ আমি বুঝি,
তুমি যে প্রতিটি কথা বলেছিলে, প্রতিটি কষ্ট সহ্য করিয়েছিলে,
সবই ছিল আমার জীবন গড়ার জন্য।
আমার আফসোস শুধু একটাই-
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে
কখনো বলতে পারিনি-
“বাবা, আমি তোমাকে মায়ের মতোই ভালোবাসি,
তুমি আমার গর্ব, তুমি আমার জীবন।”
আলোচনা
এই কবিতাটি আমার বাবার প্রতি গভীর ভালোবাসা ও স্মৃতির কথা বলে।
আমাদের জীবনে বাবার ভূমিকা অনেক সময় কঠোর শাসনের মতো মনে হয়,
কিন্তু আসলে সেই শাসনই আমাদের জীবন গড়ার মজবুত ভিত্তি।
বাবার ভালোবাসা সবসময় স্পষ্ট নয়,
কখনো শাসনে, কখনো চোখের জলেই প্রকাশ পায়।
আপনার বাবার সাথে এমন কোনো স্মৃতি আছে কি,
যা আজও আপনাকে পথ দেখায়?
কমেন্টে শেয়ার করতে পারেন।