হযরত ইউসুফ (আ.)–এর জীবনী কোরআনে সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সুগঠিত কাহিনী হিসেবে বর্ণিত
হয়েছে। সূরা ইউসুফে তাঁর জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আল্লাহ তাআলা নিজেই
বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তাঁর জীবন ধৈর্য, তাকওয়া, নিষ্কলুষতা, জ্ঞান এবং আল্লাহর
ওপর ভরসার সর্বোচ্চ উদাহরণ।
নিচে তাঁর জন্ম থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ইতিহাস কোরআন, সহীহ হাদিস এবং প্রসিদ্ধ তাফসিরের আলোকে সাজানো হলো।
১. শৈশব: আল্লাহপ্রদত্ত স্বপ্ন ও নবুওতের ইঙ্গিত
শিশু বয়সেই ইউসুফ (আ.) এক বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখেন:
“আমি দেখলাম ১১টি তারা, সূর্য আর চন্দ্র আমাকে সিজদা করছে।”
সূরা ইউসুফ 12:4
তাঁর পিতা, নবী ইয়াকুব (আ.), বুঝলেন—
- এটি নবুওতের স্বপ্ন
- ইউসুফ (আ.) আল্লাহর বিশেষ বান্দা
- ভবিষ্যতে তাঁর মর্যাদা হবে অত্যন্ত উচ্চ
২. ভাইদের হিংসা ও কূপে নিক্ষেপ
তাঁর সৌন্দর্য, চরিত্র ও পিতার স্নেহ দেখে দশ ভাই তাঁকে হিংসা করত।
তারা পরিকল্পনা করল:
“ইউসুফকে হত্যা করো অথবা কোনো দূরবর্তী জায়গায় ফেলে দাও।”
সূরা ইউসুফ 12:9
শেষে তারা তাঁকে গভীর এক কূপে ফেলে দেয়।
কূপে পড়ে তিনি ভীত হয়ে যান।
তখন আল্লাহ বলেন:
“আমি তাকে ওহী পাঠালাম যে, একদিন তুমি তাদের এই কাজের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে।”
সূরা ইউসুফ 12:15
তাফসির ইবনে কাসীর অনুযায়ী—
এই ওহী জিব্রাইল (আ.)–এর
মাধ্যমে আসে।
অর্থাৎ শিশু বয়সেই ইউসুফ (আ.)–এর সাথে জিব্রাইল (আ.)–এর সাক্ষাৎ ঘটে।
৩. কাফেলার উদ্ধার ও দাসবাজারে বিক্রি
পানি তুলতে এসে কাফেলা তাঁকে খুঁজে পায়।
“হে আনন্দ! এ তো একটি ছেলে।”
সূরা ইউসুফ 12:19
তারা তাঁকে দাসবাজারে নিয়ে যায় ও অল্প মূল্যে বিক্রি করে।
৪. মিশরের রাজপ্রাসাদে আগমন পতিফারের বাড়িতে সম্মান
মিশরের সৈন্যবাহিনীর প্রধান পতিফার (ইতফির) তাঁকে কিনে আনেন।
তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন:
“একে সম্মান করো। হয়তো আমাদের উপকারে আসবে বা আমরা তাকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করব।”
সূরা ইউসুফ 12:21
এ থেকেই শুরু হয়—
- ইউসুফ (আ.)–এর রাজপরিবারে লালন-পালন
- শিক্ষিত, সম্মানিত ও উচ্চ পরিবেশে বেড়ে ওঠা
- আল্লাহর পরিকল্পনার নতুন অধ্যায়
৫. ইউসুফ (আ.) এর অতুলনীয় সৌন্দর্য হাদিসের প্রমাণ
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“আল্লাহ সৌন্দর্যের অর্ধেক ইউসুফকে দিয়েছেন।”
(সহীহ মুসলিম)
তাঁর মুখাবয়ব দেখে মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত।
৬. জুলেখার প্রলোভন ও সাত দরজার মুজিজা
যৌবনে পৌঁছানোর পর জুলেখা তাঁকে নিজের কক্ষে ডেকে নেয়।
“সে দরজাগুলো বন্ধ করে বলল: ‘এসো আমার কাছে।’”
সূরা ইউসুফ 12:23
ইউসুফ (আ.) বললেন:
“আমি আল্লাহর আশ্রয় চাই।”
তাফসির ইবনে কাসীরে আছে
জুলেখার ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে
জিব্রাইল (আ.) উপস্থিত হন
এবং বলেন:
“দরজার দিকে দৌড়াও।”
তিনি দৌড়াতে শুরু করলে
- প্রথম দরজা খুলে যায়
- দ্বিতীয় দরজা খুলে যায়
- এভাবে সাতটি দরজাই আল্লাহর হুকুমে খুলে যেতে থাকে
৭. জামা পেছন দিকে ছেঁড়া সত্যের প্রকাশ
জুলেখা তাঁর জামা টেনে ধরলে
“তার জামা পেছন দিক থেকে ছিঁড়ে গেল।”
সূরা ইউসুফ 12:25
এটি দেখেই মূল সত্য প্রকাশ পায়।
এরপর আল্লাহ একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটান—
শিশুর সাক্ষ্য
বর্ণনা: ইবনে কাসীর, তাবারী, কুরতুবী
প্রাসাদের একটি শিশু কথা বলে:
“যদি তাঁর জামা সামনে থেকে ছেঁড়া হয় তিনি দোষী।
আর যদি পেছন থেকে ছেঁড়া হয় তিনি নির্দোষ।”
সূরা ইউসুফ 12:26–27
এই সাক্ষ্য প্রমাণ করে:
- ইউসুফ (আ.) সম্পূর্ণ নির্দোষ
- জুলেখা মিথ্যা বলেছে
৮. শহরের নারীদের ভোজসভা: হাত কেটে ফেলে বিস্ময়ে
জুলেখাকে বিদ্রূপ করায় তিনি সম্ভ্রান্ত নারীদের ভোজে ডাকেন।
যখন ইউসুফ (আ.) কক্ষে প্রবেশ করেন
“তারা বিস্ময়ে নিজেদের হাত কেটে ফেলে বলল
এ তো মানুষ নয়, এ তো ফেরেশতা।”
সূরা ইউসুফ 12:31
৯. কারাগারে প্রেরণ তাকওয়ার পরীক্ষা
নারীদের চাপ ও রাজকীয় কৌশলের কারণে তিনি কারাগারে যান।
ইউসুফ (আ.) নিজের ইচ্ছায় বলেন:
“ওরা আমাকে যেদিকে ডাকছে তার চেয়ে কারাগার আমার কাছে প্রিয়।”
সূরা ইউসুফ 12:33
তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কষ্টকে বেছে নেন।
১০. কারাগারে দাওয়াত, স্বপ্ন ব্যাখ্যা ও মুক্তি
জেলে থেকেও তিনি দ্বীনের দাওয়াত দেন।
দুই কয়েদির স্বপ্ন ব্যাখ্যা করে দেন। পরে রাজা স্বপ্ন দেখলে সে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শুধু ইউসুফ (আ.)–ই দিতে পারেন।
১১. জুলেখার স্বীকারোক্তি অপবাদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি
জেল থেকে মুক্তির আগে ইউসুফ (আ.) বলেন:
“আমার নির্দোষতা সবাই জানতে পারুক।”
জুলেখা তখন ঘোষণা করেন:
“অবশ্যই আমি-ই তাকে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিলাম। সে সত্যবাদী।”
সূরা ইউসুফ 12:51
এভাবে তাঁর সম্মান সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১২. মিশরের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়া
রাজা যখন তাঁর জ্ঞান ও সততা পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হলেন, তখন তাঁকে বলেন:
“তুমি আজ আমাদের কাছে সম্মানিত ও বিশ্বস্ত।”
ইউসুফ (আ.) বলেন:
“আমাকে দেশের ভাণ্ডারের দায়িত্ব দিন। আমি সংরক্ষণে পারদর্শী।”
সূরা ইউসুফ 12:55
আল্লাহ বলেন:
“এভাবে আমি ইউসুফকে দেশে প্রতিষ্ঠিত করলাম।”
সূরা ইউসুফ 12:56
তিনি অর্থমন্ত্রী + খাদ্যমন্ত্রী + প্রশাসনিক প্রধান সব কিছু একসাথে ছিলেন।
আজকের ভাষায়
মিশরের প্রধানমন্ত্রী।
১৩. দুর্ভিক্ষকালে মিশর ও পার্শ্ববর্তী দেশের ত্রাণদাতা
সাত বছরের দুর্ভিক্ষে—
- মিশরের মানুষ
- কানান দেশ (ইসরাইল অঞ্চল)
- পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলো
সবাই তাঁর কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করত।
“মানুষ দল বেঁধে তাঁর কাছে আসতে থাকে।”
সূরা ইউসুফ 12:58
তাঁর ভাইয়েরাও খাদ্য নিতে এসে তাঁকে চিনতে পারেনি।
১৪. স্বপ্ন পূর্ণতা পরিবার সিজদাহে নত হলো
শেষে ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর পরিবার মিশরে চলে আসেন।
“বাবা-মাকে সিংহাসনে বসালেন এবং তারা তাঁর সামনে সিজদারত হলো।”
সূরা ইউসুফ 12:100
এটাই তাঁর শৈশবের স্বপ্নের বাস্তবায়ন।
তাফসিরকাররা বলেন:
এটি সম্মানের সিজদাইবাদতের
নয়।
১৫. নবুওত, হিকমাহ ও জ্ঞান
আল্লাহ বলেন:
“আমি তাঁকে জ্ঞান ও হিকমাহ দিয়েছিলাম।”
সূরা ইউসুফ 12:22
এবং:
“আমি তাঁকে স্বপ্ন ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করেছিলাম।”
সূরা ইউসুফ 12:6
১৬. মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মর্যাদা, নিরাপত্তা ও নেতৃত্ব
তাফসিরসমূহে রয়েছে:
- তিনি জীবনের শেষ পর্যন্ত মিশরের প্রধান ছিলেন
- মানুষ তাঁকে ভালোবাসত
- তাঁর জ্ঞান ও ন্যায়বিচারের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে
১৭. মৃত্যুর দোয়া আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা
ইউসুফ (আ.) আল্লাহর কাছে দোয়া করেন:
“হে প্রভু, তুমি আমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে মর্যাদা দান করেছো।
আমাকে মুসলিম হিসেবে মৃত্যু দাও এবং সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিয়ে দাও।”
সূরা ইউসুফ 12:101
১৮. হাদিসে ইউসুফ (আ.) এর আখিরাতের মর্যাদা
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন:
“ইউসুফ ছিলেন মহান ব্যক্তি, মহান ব্যক্তির সন্তান, তাঁর সন্তান ও তাঁর সন্তান।”
তিরমিজি
অর্থাৎ:
- ইউসুফ (আ.)
- ইয়াকুব (আ.)
- ইসহাক (আ.)
- ইব্রাহিম (আ.)
- সবাই মহান নবী।
সারসংক্ষেপ: আল্লাহ ইউসুফ (আ.)–কে যে প্রতিদান দিলেন
দুনিয়ায়:
- মিশরের প্রধানমন্ত্রী
- রাজপ্রাসাদের নেতৃত্ব
- অপবাদ থেকে মুক্তি
- সারা মিশরের অর্থনীতি হাতে
- স্বপ্ন ব্যাখ্যার মুজিজা
- রাজকীয় সম্মান
- পরিবারের মিলন
- শৈশবের স্বপ্ন পূর্ণতা
আখিরাতে:
- আল্লাহর বিশেষ প্রিয় বান্দা
- নবীদের শ্রেষ্ঠ বংশধর
- ফেরেশতার মতো সৌন্দর্য
- উচ্চ মর্যাদা ও সম্মান
Shop Noon
Shop Namshi
-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%A3-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8%E0%A7%80--%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%AE,-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BE,-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A6,-%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A7%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%B9%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE-%E0%A6%93-%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A8.jpg)
