ইসলামের দৃষ্টিতে রাগ বা ক্রোধ আমল নষ্ট করে ।

মানবচরিত্রের একটি খারাপ দিক ক্রোধ। কারো ক্রোধ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখন সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রোধান্বিত মানুষ বেসামাল হয়ে যায়, তখন অন্যের ওপর জুলুম করে। ক্রোধের কারণে মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে, তখন খুনখারাবি পর্যন্ত হয়ে যায়, ঘরসংসার ভেঙে যায়। গিবত-সমালোচনার পেছনেও মানুষের ক্রোধ কাজ করে, প্রতিপক্ষের উন্নতি সহ্য হয় না। শয়তান ক্রোধের ইন্ধন জোগায়, কারণ ক্রোধ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে। ক্রোধ নিবারণ অপরিহার্য, নচেৎ জীবনের সমূহ বিপর্যয় অনিবার্য। এক সাহাবি রাসূল সা:-এর কাছে এসে বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাকে অল্প কথায় কিছু নসিহত করুন, রাসূল সা: বললেন, ক্রোধ বর্জন করো। সাহাবি কয়েকবার বললেন, আরো নসিহত করুন। প্রত্যেকবারই রাসূল সা: বললেন, ক্রোধ বর্জন করো। (বুখারি)। এ থেকে বোঝা যায়, ক্রোধ বর্জন করার গুরুত্ব কতখানি। দ্বীনের পথে চলতে হলে ক্রোধ হজম করা অত্যন্ত জরুরি।



 জীবনের সব ক্ষেত্রে ক্রোধ বর্জনীয়। সাহাবি আবু বকর রা:-এর পুত্র সিজিস্তানের কাজী ছিলেন। তিনি তাকে লিখে পাঠালেন ক্রোধ অবস্তায় কখনো বাদি-বিবাদির মধ্যে রায় প্রদান করবে না। আমি রাসূলকে বলতে শুনেছি, বিচারকের জন্য ক্রোধাবস্তায় বাদি-বিবাদির মধ্যে রায় প্রদান করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। (বুখারি)। এতে বুঝা যায় ক্রোধ অবস্তায় রায় ইনসাফ-ভিত্তিক হয় না। রাসূল সা: বলেছেন, প্রকৃত বাহাদুর সেই ব্যক্তি, যে ক্রোধের সময় নিজেকে সংযত রাখতে পারে। (মুসলিম)। আল্লাহপাক কুরআনে কারিমের এক আয়াতে নেককার মানুষের গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন, ‘যারা নিজেদের ক্রোধ হজম করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস’ত আল্লাহ সৎ কর্মশীলদেরই ভালোবাসেন।’ (সূরা আল ইমরান-১৩৪)। ইমাম বায়হাকি এই আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। হজরত আলী বিন হোসাইন অজু করছিলেন। তার এক বাঁদি পানি ঢেলে দিচ্ছিল। হঠাৎ পানির পাত্র হাত থেকে ফসকে গিয়ে হজরত হুসাইনের পায়ে পড়ে যায়। এতে তার কাপড়-চোপড় ভিজে যায় এবং পায়ে ব্যথা পান। এমতাবস্তায় রাগান্বিত হওয়া স্বাভাবিক। বাঁদি বিপদের আশঙ্কা করে তৎক্ষণাৎ আয়াতটির প্রথম দুই শব্দ ‘ওয়াল কাজেমিনাল গায়জা’ পাঠ করল। আয়াতটির অংশটুকু শোনামাত্রই হুসাইন রা:-এর ক্রোধানল একেবারে নিভে গেল। তিনি নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। এরপর বাঁদি দ্বিতীয় অংশ পাঠ করল। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। বাঁদিও সুযোগ বুঝে আয়াতের শেষ অংশ পাঠ করল। হজরত হুসাইন শেষ অংশ শোনামাত্রই বললেন, যাও আমি তোমাকে আজাদ করে দিলাম। (রুহুল মানি)।

ইমাম আবু হানিফা রা:কে এক ব্যক্তি গালিগালাজ করল। তিনি গালি শুনেও ক্রোধ সংবরণ করলেন, তাকে কিছু বললেন না। ঘরে ফিরে একটি খাঞ্চায় অনেক সোনা-রুপাভর্তি করে ওই ব্যক্তির বাড়ি গেলেন। দরজায় কড়া নাড়তেই লোকটি বের হয়ে এলো। তিনি স্বর্ণ-রুপাভর্তি খাঞ্চাটি তার সামনে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আজ আপনি আমার প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন অর্থাৎ স্বীয় পুণ্য সব আমাকে দান করেছেন। এ অনুগ্রহের প্রতিদানে এ উপঢৌকন পেশ করছি, গ্রহণ করুন। লোকটির অন্তরে ইমামের এ ব্যবহারের প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। সে তাওবা করে ইমামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। এরপর ইমামের সংসর্গে থেকে বিদ্যা শিক্ষা করে একজন আলেম হয়ে গেল। ইমামের ক্রোধ সংবরণ করার ঘটনা অনেক, যা অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। রাসূল সা: বলেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হবে আল্লাহর কাছে কারো কোনো পাওনা থাকলে দাঁড়িয়ে যাও। তখন ওই সব লোক দাঁড়াবে, যারা দুনিয়াতে অপরের অত্যাচার-উৎপীড়নে ক্রোধান্বিত বা রাগ না হয়ে ক্ষমা করেছিল। রাসূল সা: আরো বলেন, যে ব্যক্তি জান্নাতে তার সুউচ্চ প্রাসাদ ও মর্যাদা কামনা করবে, তার উচিত অত্যাচারীকে ক্ষমা করা, যে তাকে কখনো কিছু দেয় না তাকে বকশিশ ও উপঢৌকন দেয়া এবং যে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তার সাথে মেলামেশা করা। রাসূল সা: সাহাবায়ে কেরামের সামনে বললেন, সব নবী ছাগল চরিয়েছেন। সাহাবাদের একজন প্রশ্ন করলেন- আপনিও চরিয়েছেন? উত্তরে হ্যাঁ, আমিও কিছু দিরহামের বিনিময়ে একজনের ছাগল চরিয়েছি। (বুখারি)। ছাগলের মধ্যে একটা বিপরীতমুখী স্বভাব আছে। যেদিকে নিতে চায় তার বিপরীত দিকে যেতে চায় এমনকি রশি লাগিয়ে সামনের দিকে টানলে পেছনের দিকে যেতে চায়। ক্রোধান্বিত ব্যক্তি ছাগল চরাতে পারে না। ছাগল চরানোর মাধ্যমেই ক্রোধ প্রশমিত করার কৌশল শিখে নিতে হয়। মানুষের মধ্যে বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে বিপরীতমুখী স্বভাব আছে, তার জন্য দ্বীনি দাওয়াত ও শিক্ষার ব্যাপারে কৌশল অবলম্বন করতে হয়। আল্লাহপাকের নির্দেশ ‘আপন পালনকর্তার পথে আহ্বান করো জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে’ (সূরা নহল-১২৫)।

হজরত মুসা ও হজরত শোয়েব আ: ছাগল চরাতেন, একদিন পালের একটি ছাগল যে দিকে নিতে চায় সেদিকে না গিয়ে বিপরীত দিকে ছুটে পালাতে শুরু করে। হজরত মুসা আ:ও ছাগল হাঁকানো লাঠি নিয়ে ছাগলটির পেছনে দৌড়াতে থাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে ছাগলটি ক্লান্ত হয়ে থেমে কাঁপতে শুরু করল। হজরত মুসা আ:-এর উদ্দেশ্য ছিল নাগাল পেলেই পেটাবেন। কিন’ কাঁপছে দেখে মুসা আ:-এর অন্তরে দয়া হলো তিনি পেটালেন না। লাঠি ফেলে দিয়ে ছাগলটিকে কোলে তুলে পালের কাছে নিয়ে এলেন। একদিন তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে কথোপকথনের সময় আল্লাহ বললেন, হে মুসা, যে দিন তুমি ছাগলের ব্যাপারে ক্রোধকে দয়ায় পরিণত করেছিলে সে দিন তোমাকে নবী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রাসূল সা: বলেছেন, ‘ক্রোধ প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে তা সংবরণ করে, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা সব মাখলুকের সামনে তাকে আহ্বান করে যে হুর সে কামনা করবে তা গ্রহণ করার অধিকার তাকে দিয়ে দেবেন।’ (আবু দাউদ)। ক্রোধ হজম করা একটি উত্তম আমল। অপর এক হাদিসে রাসূল সা: বলেন, ‘কোনো বান্দা আল্লাহর সন’ষ্টির উদ্দেশ্যে ক্রোধের যে ঢোক গলাধঃকরণ করে আল্লাহর দৃষ্টিতে তার চেয়ে উত্তম আর কোনো ঢোক বান্দা গলাধঃকরণ করে না। ক্রোধ দমন দ্বারা আল্লাহর কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়’। যারা উঁচু মর্যাদার লোক তারা ক্রোধ বা রাগ করতে পারে না। রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যারা সিদ্দিক (অর্থাৎ দ্বীনের ক্ষেত্রে যার মর্যাদা অনেক ওপরে) তাদের পক্ষে সঙ্গত নয় অভিশাপ দেয়া।’ (মুসলিম)। অভিশাপ সাধারণত রাগের কারণেই হয়ে থাকে। তাই এ হাদিসে বলা হয়েছে ‘সিদ্দিক’ অভিশাপ দিতে পারে না। যারা অভিশাপ দেয় ও তিরস্কার করে- ক্রোধ হজম করতে পারে না তারা কিয়ামতের দিন অনেক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হবে। যেমন রাসূল বলেন, ‘তিরস্কারকারীরা কিয়ামতের দিন সুপারিশকারীও হতে পারবে না, সাক্ষীও দিতে পারবে না।’ যেসব ক্ষেত্রে ইসলাম ক্রোধ বা রাগ করার অনুমতি দিয়েছে তা হতে হবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, সে হতে হবে দ্বীনের উদ্দেশ্যে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে, নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশে নয়। রাসূল সা: বলেন, ‘ঈমান পূর্ণ করার চারটা আমল, যা কিছু মানুষকে দেবো আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য যা কিছু নেব আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। যাকে ভালোবাসব আল্লাহর উদ্দেশে ভালোবাসব। যার প্রতি রাগ করব তাও আল্লাহকে খুশি করার জন্য’। (তিরমিজি)।



সুফি সাধক যারা নফসের এসনাহ নিয়ে ব্যস্ত তাদের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা বড় সাফল্য। বিবি-বাচ্চা ছাত্র ও অধীনস’দের শাসনের খাতিরে রাগ করতে হবে। অফিস আদালত সামলানোর জন্য রাগ করতে হবে। সেসব ক্ষেত্রেই রাগকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। কুরআন-হাদিসে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার অনেক পথ বর্ণিত আছে, তা থেকে সংক্ষেপে কিছু বর্ণনা করা হলো-

১. রাসূল সা: বলেন, ‘যখন তোমাদের কারো রাগ আসে, তখন সে দাঁড়িয়ে থাকলে যেন বসে পড়ে। তাতে যদি রাগ দমে না যায় তাহলে সে যেন শুয়ে পড়ে।’ (তিরমিজি)। রাগের গতি হলো ওপরের দিকে। তাই বলা হচ্ছে- রাগ দমন করার জন্য গতি নিচের দিকে করে দাও।

২. রাসূল সা: বলেন, ‘রাগ আসে শয়তানের পক্ষ থেকে, শয়তানকে তৈরি করা হয়েছে আগুন থেকে। আগুন নির্বাপিত হয় ঠাণ্ডা পানি দ্বারা। ঠাণ্ডা পানি পান করলে রাগের কারণে রক্তে যে উষ্ণতা সৃষ্টি হয় সেই উষ্ণ ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। এভাবে রাগ পড়ে যাবে। (আবু দাউদ)।

৩. রাগের মধ্যে শয়তানের ওয়াসওয়াসার দখল থাকে। প্রকৃতপক্ষে এ রাগ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। তা বের করার জন্য আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম পড়ো। এ জন্য আল্লাহপাক বলেন, ‘যদি শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো উসকানি তোমাকে পায় তাহলে আউজু বিল্লাহি মিনাশ শায়তানির রাজিম পড়ো।’ (হা-মিম সাজদা-৩৬)।

৪. যখন তোমার রাগ হয় তখন মনে করবে, আমার সৃষ্টিকর্তা আমার চেয়ে অনেক অনেক বড়। তিনি আমার প্রতি রাগ হলে আমার কী উপায় হবে? অতএব আমি তাকে ক্ষমা করতে না পারলে সৃষ্টিকর্তাও আমাকে ক্ষমা করবেন না। আমার রাগ হজম করে তাকে ক্ষমা করে দিলে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। এভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণে এসে যায়। আল্লাহ বলেন, ‘মনে রাখবে অবশ্যই আল্লাহ সুমহান, সমুচ্চ অনেক বড়।’ (সূরা নিসা-৩৪)।

Post a Comment

Previous Post Next Post